হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ :

বৃষ্টিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন রোহিঙ্গারা। সদ্য অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারের আরাকানে এখনও অবস্থান রত বাংলাদেশে পালিয়ে আসার জন্য অপেক্ষমান রোহিঙ্গা উভয়েরই একই দশা বলে জানা গেছে।

সীমান্ত এলাকা ঘুরে এবং বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, গত কয়েক দিনে টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এরা এখনও মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করতে পারেননি। এদিকে গত কয়েক দিন ধরে চলছে মাঝারী ও ভারী বৃষ্টি এবং দমকা হাওয়া। অপরদিকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের আকিয়াব, চপ্রু, টানডুয়ে ও মংডু জেলার মংডু সদর, বুচিডং, রাচিডং, পুংঁনাজুঁেয়, কিয়ট্র, পাত্তরিকিল্লা, মাংব্রা, পকট, ¤্রঅেং, আং, চপ্রু সদর, রামব্রি, মেআং, টংগু, টানডুয়ে সদর, গোয়া, আকিয়াব সদর এই ১৭টি থানা বা টাউনশীপ থেকে ৫ লক্ষাধিক নতুন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এখনও লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার জন্য অপেক্ষমান আছে। তম্মধ্যে অনেকেরই বসতবাড়ি নেই। সেনা-মগরা পুড়িয়ে দিয়েছে। বাস্তহারা গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে প্যরাবনে ও ক্ষেতে পালিয়ে লুকিয়ে আছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু। এরা সকলেই বৃষ্টিতে ভিজছে আর রোদে পুড়ছে। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

জাতিসংঘের তথ্য মতে মিয়ানমারে রাখাইনে সেনাবাহিনীর সহিংসতার মুখে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তবে এ সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে ধারনা স্থানীয়দের। এর মধ্যেও নিপীড়নের শিকার হয়ে এ সংখ্যালঘু এ জনগোষ্ঠীর আরও অনেক রোহিঙ্গা টেকনাফের লম্বাবিল সীমান্তবর্তী নাফ নদীর ওপারের কুমিরখালী এলাকায় প্রবশের অপেক্ষায় আছেন। তারা সেখানে বৃষ্টিতে ভিজছে, রোদে পুড়ছে বলে জানিয়েছেন সদ্যঅনুপ্রবেশকারী সুলতান মিয়া। তিনি শুক্রবার ২০ অক্টোবর সকালে নাফনদী পার হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে টেকনাফের লম্বাবিল পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন ‘মিয়ানমারের নাফনদী ঘেষা মংডু ও মাঝখানের পাহাড় পূর্বে বুচিডং টাউনশীপ। এ পাশ থেকে বুঝার উপায় নেই মংডুতে কি হচ্ছে। ৫ দিন পায়ে হেঁটে পাহাড় পেরিয়ে পৌছি মিয়ানমার মংডুর কুমিরখালী এলাকায়। আসার পথে দেখা মিলেনি কোন মানুষ, নিশ্চুপ নির্জন সব গ্রামগুলো। যেন মনে হয় মৃত্যুপুরী। ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে আছে। রয়েছে শুধু মানুষের গন্ধ। কুমিরখালীতে এসে দেখা মিলে হাজারো রোহিঙ্গাদের ঢল, যারা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষা করছে। অনুমানিক সেখানে ২০ হাজার মতো হতে পারে। তারা নৌকা না পেয়ে সেখানে সবাই কান্নাকাটি করছে। শিশুদের অবস্থা গুরুতর। তারা বৃষ্টিতে ভিজছে, রোদে পুড়ছে। তার বাড়ি মিয়ানমার বুচিডং টাউনশিপ সিন্ডিপ্রাং গ্রামে। বুচিডং গত দুই দিন আগে আবারো নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে সেনাবাহিনী। ফলে আবারো অনেকে ভয়ে মানুষ বাংলাদেশমুখী হওয়া শুরু করেছে। এপারে এক মাস আগে আমার এক চাচতো ভাই চলে এসেছিল। তার মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটি নৌকা ভাড়া করে এপারে থেকে নিয়ে পরিবারের ২০ সদস্যসহ ৩০ জনের একটি দল টেকনাফের লম্বাবিল নামক এলাকা দিয়ে এপারে প্রবেশ করি। নৌকা করে চলে আসার সময় সেখানে থাকা রোহিঙ্গারা চিৎকার করে বলতে শুরু করে আমরা খুব অসুস্থত একটু নৌকায় করে নিয়ে যান। সবার একই অবস্থা, কাকে রেখে কাকে আনবো। অবশেষে অসুস্থ আরও ১০ জন নিয়ে চলে আসি। এভাবে তারা সেখানে পড়ে থাকলে না খেয়ে এবং চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। মিয়ানমার বুচিডং টাউনশিপ সিন্ডিপ্রাং বাজারে আমার একটি মোবাইল ফোনের দোকান ছিল। সেনারা আমার দোকান লুট করে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে।

তার দলের সঙ্গে আসা দিল বাহার (৩৫) নামে এক রোহিঙ্গা নারী বলেন ‘আমরা বুচিডং টাউনশীপ পুইমালি গ্রামের বাসিন্দা। আমিসহ ৫ গ্রামের মানুষ ৭ হাজার রোহিঙ্গা গত সপ্তাহে ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার জন্য রওনা দিয়েছিলাম। পাহাড় পর্বত, বন-জঙ্গল, খাল-বিল, নদী নালা পেরিয়ে ক্ষুধাতৃষ্ণায় তারা কাতর হয়ে পড়ি। গত বুধবার মিয়ানমারের মংডু কুমিরখালী এলাকায় পৌছি। কিন্তু নৌকা না পাওয়ার কারনে এতোদিন আসতে পারেনি। শুক্রবার আরেক জনের একটি নৌকা করে এপারে প্রবেশ করি। আমা ছোট মেয়ে সমিলা খুবই অসুস্থত হয়ে পড়ে। সেখানে দুই দিন বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছিল। আমার মোট ৮ ছেলে মেয়ে রয়েছে। আমার স্বামী নুরুল আলমকে সেনাবহিনীর সদস্য ধরে নিয়ে হত্যা করে। এরপর থেকে সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে বেড়াই। সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা যেসব গ্রামে এখনো রোহিঙ্গা অবস্থান করছে তাদেরকে বর্মী ভাষায় লেখা ‘বাঙালি কার্ড’ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। কেউ তা নিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছেন। এ কারণে রোহিঙ্গা দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন’।

গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে পুলিশের নিরাপত্তা তল্লাশি চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর কঠোর সেনা অভিযান শুরু হয় রাখাইনে। জাতিসংঘ বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে জাতিগত নিধনের চেষ্টা করছে। এদিকে স্যাটালাইটে পাওয়া নতুন তথ্য বিশ্লেষণ করে ২৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ২৮৮টি গ্রাম সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

টেকনাফের হোয়াইক্যং পুটিবনিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন ‘শুক্রবার সকালে সীন্ত দিয়ে প্রায় পাচঁ হাজার মতো রোহিঙ্গা প্রবেশ করে এ ই পাহাড়ে আশ্রয় খুজছেন। এছাড়া প্রবেশের অপেক্ষা রয়েছে আরও ২০ হাজারের মতো, তারা সেখানে বৃষ্টিতে ভিজছে, রোদে পুড়ছে, যেকোন সময় ঢুকতে পারে’।

মিয়ানমারের নাগরিক আবুল কাশেম লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকছেন এক মাসের বেশি সময় ধরে। তিনি বলেন ‘প্রথমে থাকা-খাওয়ার কস্ট হলেও এখন অনেকটা ভাল আছে। এখন সমস্যা হচ্ছে বৃষ্টি আর বাতাস। গত বৃহস্পতিবারও বৃষ্টির পরে রাতে ঘরে ঘুমাতে পারিনি। ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে পাশের একজনের বাড়ি বা ছাউনিতে রাত কাটিয়েছি। আমাদের ঘর বলতে পলিথিনের ছাউনি। এখানে একটু বেশি বৃষ্টি হলে সেটা কোন না কোনভাবে ঘরে ঢুকে পড়ে। তখন ঘরের ভেতরে কাঁদা হয়ে যায়। তখন বসেও থাকায় যায় না। আর বাতাস হলে আরো ভয়ের মধ্যে থাকি। যদি বাতাসে উড়ে যায় বা ভেঙ্গে যায় তাহলে আরো বিপদ। তাই বৃস্টি আর বাতাস হলে আল্লাহকে স্মরন করে পরিবার নিয়ে বসে থাকি’। একই ক্যাম্পের আরেক রোহিঙ্গা বশির ঊল্লাহ বলেন ‘আমি যে জমি পেয়েছি সেটা পাহাড়ের একদম ঢালুতে। তাই তাই যে কোন মূহুর্তে মাটি পড়ে ঘর ভেঙ্গে পড়তে পারে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মাটি-পানি ঘরে ঢুকে পড়ে। তখন ঘরের মধ্যে কাঁদা-মাটিতে একাকার হয়ে যায়। ঘরে থাকার উপায় থাকেন না। শুক্রবার দিনভর বৃষ্টির পরে ঘরের অবস্থা খুবই করুন হয়ে গেছে। এখন আছি পরিচিত আরেক জনের ঘরে। তার ঘরেও মানুষ বেশি। সে কারনে ২/৩ টি ঘরে ভাগ হয়ে আছি। মোট কথা বৃষ্টি আর বাতাস হলে খুব ভয়ের মধ্যে থাকি। আমাদের সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করতে এখানে সরকারে পক্ষ থেকে অনেক মানুষ আছে, কিন্তু ঝড় বৃষ্টি হলে তারা কি করবে ?

মোচনী ক্যাম্পে অবস্থানরত আসির আলী বলেন ‘জীবন বাচাঁতে আজ আমি এখানে পড়ে আছি। অথচ মংডুতে আমার অনেক বড় বাড়ি ছিল। সেখানে যেকোন ধরনের বিপদ-আপদে মানুষ আমার ঘরে আশ্রয় নিতো। সারা জীবন আমি অনেক মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি। ভাত কাপড় দিয়েছি। অথচ আজ আমি নিজেই আশ্রয়হীন। সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছা। বাংলাদেশের মানুষের ঋন কখনো কোন রোহিঙ্গা শোধ করতে পারবে না। বাংলাদেশের হুকুমত (সরকার) আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে। খাবার থেকে শুরু করে চিকিৎসা সব কিছু করছে। আর এত বেশি ত্রাণ দিচ্ছে এখন খেতে না পেরে অনেকে বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছে। তবে এখানে আসার পরে কয়েক বার বৃস্টির কারনে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। যখন বৃষ্টি হয় তখন পরিবার পরিজন নিয়ে খুব বিপদে থাকি। কারন পাহাড়ের জমিতে আমরা যে ঘর করেছি মোটা একটি পলিথিন দিয়ে ইতিমধ্যে পলিথিনে কয়েকটি ফুটো হয়ে গেছে। তাই বৃষ্টি হলে পানি ঘরে ঢুকে পড়ে। আর জোরে বাতাস হলে পলিথিন ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তাই খুব ভয়ে থাকি যখন বৃস্টি আর বাতাস হয়’।

টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে কর্মরত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এখন আগের তুলনায় বেশ নিয়ন্ত্রণে। তবে বৃষ্টি হলে তাদের মধ্যে একটি আতংক তৈরি হয়ে যায়। সব ঘর কাঁচা এবং খুবই নরম হওয়ায় বৃস্টি এবং বাতাস হলে যে কোন মূর্হতে নস্ট হয়ে পড়ার আশংকা আছে। আমি দেখেছি, আকাশে ভারী মেঘ হলেও তারা খুব দুঃশ্চিন্তায় থাকে’। কুতুপালং ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন বলেন ‘এখানে কিছু বাড়ি আছে একদম পাহাড়ে, আবার কিছু আছে পাহাড়ের ঢালুতে। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ভারী বৃষ্টি হলে এখানে পাহাড় ধ্বসের আশংকাও আছে। আর স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে সাথে বাতাস হলে ওইসব ঘর এমনিতেই ভেঙ্গে পড়বে। অবশ্য এর চেয়ে বেশি কিছু করা আপাতত সম্ভবও নয়। এত বেশি মানুষকে ভালভাবে ঘর তৈরি করে দিতে গেলে অনেক জায়গা এবং সহযোগিতার দরকার’।

উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ মেজবাহ উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, রোহিঙ্গাদের জীবন মান উন্নয়নে সব ধরনের সেবা মূলক কাজ করছে সরকার। এখানে স্বাস্থ্য সেবা থেকে শুরু করে পানি স্যানিটেশন এবং পুষ্টি সব দিকে নজর রাখা হচ্ছে। আর কিছু প্রাকৃতিক ব্যাপার আছে। সেখানে কারো কিছু করার থাকে না। এর মধ্যে ঝড় বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দূর্যোগ। এটা ঠিক যে বৃষ্টি বা ভারী বাতাস হলে রোহিঙ্গাদের কিছু সাময়িক সমস্যা হয়। তবে আমার জানা মতে, এখানে প্রচুর দেশি বিদেশী সংস্থা এসব বিষয়ে কাজ করছে। ##